আঁখি জলে ভাসি-০১-০৩
লিখেছেন লিখেছেন Saidul Karim ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০১:১২:৫৮ দুপুর
জানালা খোলা।খাটের একপাশে শুয়ে আছি।চাঁদের মোলায়েম জ্যোতির কিঞ্চিৎ এসে পড়েছে রুমের মেঝেতে।বিছানা ছেড়ে দেয়াল ঘেষে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়; আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ,দূরের অস্পষ্ট ঝোপ-ঝাড়ে ঝোনাকিদের এলোমেলো আলোর ছড়াছড়ি। শোনা যাচ্ছে,বিলের ক্ষুদ্রজলাশয়ে সুখে উল্লাসিত নানা পোকা-মাকড়ের শোরগোল।মাঠের পাকা ধানের শিষগুলো হেলে পড়েছে এদিক ওদিক।দক্ষিণা উদাস বাতাসের শন শন ধ্বনিতে মনটা কেমন যেন হু হু করে কাঁদছে।হৃদয়ের পাতায় পাতায় অনেক সুখ বিষাদের স্মৃতি উকি দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অচেনা গন্তব্যে। মনের দর্পনে ভেসে ওঠছে কয়টি প্রিয় মূখ;যাদেরকে হারিয়েছি অবেলায়।
গিয়াস উদ্দীন ভাই ছিল আমার এক বছর সিনিয়র।সবেমাত্র দাখিলের নির্বাচনী পরিক্ষা দিয়েছে সে।তখন ঈদুল আযহা সংলগ্ন পরিক্ষার বন্ধ।সমাজের ঐতিহাসিক সূত্রে বহুপত্নীক পরিবারে একপক্ষ বঞ্চিতা হয়।গিয়াস উদ্দীন ভায়ের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি।কারণ,সে ছিল তার বাবার ছোট স্ত্রীর ছেলে।ঈদুল আযহার আগের দিন ঈদীর প্রত্যাশায় সুপারি গাছে উঠতে গিয়ে সৎ ভায়ের বাঁধার সম্মুখিন হন।সে বাঁধা না মানায় তার সৎ ভাই তাকে দা-ছুরি দিয়ে আঘাত করে।এটি কোন সংশোধনীমূলক আচরণ নয় বরং; প্রতিশোধের রুপান্তরিত রুপ মাত্র।আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে গিয়াস উদ্দীন।স্থানীয় চিকিৎসকরা তাকে ট্রিটমেন্ট দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করলে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।সেখানেই মৃত্যু হয় একটি গোছালো স্বপ্নের।তার বিধবা বৃদ্ধা মায়ের বুকে নামে কালো মেঘের ঘনঘটা।
এভাবে প্রতিনিয়ত খুন,গুম ও রোড এক্সিডেন্টে কত প্রিয়জন হারিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু শাষক শ্রেণী দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দিতে যত্নবান নন।তবু কোন শাষক যদি দশ টাকা মূল্যে চাল এবং ঘরে ঘরে চাকরির আশ্বাস দেয় আমরা তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি।কারণ,ভাত আমাদের অনেক প্রিয়।যদি কখনো কেউ ভাতের বদল মিষ্টি আলো খেতে বলে! যে জাতি বেনিয়াদের গোলামী করে দু'শত বছর অতিক্রম করেছে তাদের থেকে উদ্যোগতা প্রত্যাশিত নয়;তাদের চাকরির লোভ থাকবে স্বাভাবিক।কালের আবর্তনে বেনিয়া এখন গণতান্ত্রিক শাষক।গোলামীর পরিবর্তে মর্মস্পর্শী শব্দ 'চাকরি'।অপরাধীরা সম্পদের কুমীর হওয়ায় ছাড়াপায় রাতারাতি।ইনসাফের প্রশ্ন এখানে গৌণ।তবু এদেশে বৃষ্টি হয়,জমিতে দ্বিগুন ফসল ফলে,নদী-সাগরে মাছের কমতি নেই।এটা কী এদেশের বন-জঙ্গলে পশু-পাখী আছে বলে নাকি আমাদের সরল মনের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টির প্রতি আল্লাহর আশীষ?
০২
আকাশে খন্ড খন্ড মেঘের আনাঘোনা।মেঘের আড়ালে লুকুচুরি খেলে ঘুমন্ত পৃথিবীকে চাঁদ পাহারা দিচ্ছে।পাখ-পাখালীরা বিভোর স্বপ্নের রাজ্যে।এই চাঁদ অসীম কালের সাক্ষী,বিরহীর প্রিয় স্বজন।নিশিতে ফুটা পুষ্প,হাসনাহেনার ঘ্রাণ চাঁদের স্নিগ্ধ ঝোসনাকে আরোবেশি মাননসই করেছে।এই ঘ্রাণ আমাকে বিমোহিত করে অজানা এক আবেশে;হারিয়ে যায় স্মৃতির নিবিড় সীমানার অন্দর মহলে।
দাখিল পরিক্ষার কোচিং শুরু হয়েছে।টানা পাঁচ ঘন্টা ক্লাস,মধ্যখানে জোহরের নামায ও হালকা নাস্তা; তারপর কোচিং শুরু।ছাত্রীদের অনেকে আগেভাগে উপস্থিত;বাকীরা কয়েক মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হবে।শুনেছি,আজ তাদের কেউ হট-টিপিনে করে খাবার আনেনি।কেন আনবে? দস্যু প্রকৃতির কতিপয় ছাত্র ক্লাসের ফাঁকে তাদের খাবারগুলো আজীজ ভায়ের দোকানে বসে মজা করে যে খেয়ে ফেলে! আমি কিন্তু আবার এসবে থাকিনা,জাস্ট খাওয়ার সময় রান্না কেমন হয়েছে দেখি!এখন মনটা ভালো যাচ্ছেনা।ছাত্রীদের টিপিন না আনা মানে আমাদের জন্য মান্না-ছলওয়া বন্ধ! যাক,তাই বলে কি না হেসে থাকব। নিজেরা চুরি করে লেজ কেটেছি বাকীদের লেজ থাকার দরকার কি! প্লান মাফিক ঘোষিত হল-এখন একটা নির্বাচন হবে আর প্রার্থী হবে ছাত্রীদের থেকে।ছাত্রীদের একজন বলে,তোমাদের থেকে কেন প্রার্থীহবেনা? আমরা মুচকি হাসি।বিড়াল কে মাছ পাহারার দায়িত্ব দিলে মাছ যদি কমে না যায় বুঝতে হবে মাছে ফর্মালিন আছে! ভোট হলো।কেউ পেল দুইটি কেউ বা তিনটি কিন্তু,তানিয়া পেল নয়টি।ফলাফল ঘোষনা করলাম আমি- আজ থেকে আমাদের ক্লাসের বাকী সময়ের জন্য কিপটামীর সভাপতি নির্বাচিত হলেন;তানিয়া সুলতানা সেজু! আমরা আবার হাসি, একেবারে অট্টহাসি! আমাদের হাসি মুখের এ পাশ থেকে ও পাশ ছড়িয়ে যায়।হাসতে পারেনা তানিয়া ও তার সাথীরা।তার মাঝে দেখতে পায় সমাজের প্রতিচ্ছবি।ভাবি,তুদের মত আটকপালেরাই ফাঁদে পা দেয়। সে আজ আর নেই। বিয়ে হয়ে গেছে দু'বছর আগে।মনে হয়,মেয়েদের জন্ম হয় বিয়ের জন্য!তার মত নেই অনেকে।এখন আর সেই চঞ্চল,নাদুস-নুদুস কামিলা জাহান মিশুর সাথে কারো ঝগড়া হয়না।হয়না দু'চারজন মিলে "টুইন্যার" দোকানের পিঁপড়া মিশ্রিত ছনামুড়ি খাওয়া।
বাস্তবতার তাকিদে আমরা আজ অনেক দূরে।ভাবার সময় নাই দীর্ঘ পথ চলা সেই সহপাঠিদের নিয়ে।শাহেনা,ডালিয়া,মুনিয়া ও সেলি হয়তো শুনতে পাচ্ছে পৃথিবীর সুন্দরতম ডাক 'মা'।নেছার,হামিদ,দেলোয়ার,শাহেদ,কাশেম কেউ পাশে নেই।সিরাজ চলে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্গ,সৌদি আরবে।সে মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা বলে,জানতে চাই কেমন আছি। তেমনি কথা হয় আমার হবু শাশুড়ী তথা আসমা,তানমিন ওসামিরার সাথে।জুনাইদ আর আমি আছি আগের মত, অনেকটা পাশাপাশি।
[০৩]
কুহু কুহু করে একটা পাখি অনেক ক্ষণ ডাকছে।এখন আর সে পাখিটির ডাক শুনা যাচ্ছে না।মায়ের মুখে শুনেছি,যে বাড়ির আঙ্গিনায় এই পাখি ডাকে সে বাড়ির কোনো কুটুম্বের অকল্যাণ হয়।
মাঝে মাঝে এই কুহু পাখির ডাক আমাদেরকে অদৃশ্য জগতের শঙ্কায় তাড়িত করে।মনে পড়ে আমার আব্বার নিরবে চলে যাওয়া।তিনি আমাকে শিখিয়েছেন অর্জিত সম্পদের মূল্যায়নের কথা,আত্ম-সম্মানও চিরন্তন মূল্যবোধের পরিচয়।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, যখন আমি কুরআনের পনের খন্ড মুখস্থ করেছি তখন একদিন দর্জির দোকানে গিয়েছিলাম পাঞ্জাবী সেলাই করবো বলে।শিক্ষকের কঠোর নিষেধাজ্ঞা-'এমব্রয়ডারি করে পাঞ্জাবী পরিধান করা যাবেনা'।কেননা,এটি হারাম! বিলকুল হারাম! দোকানদার বিভিন্ন কাপড় দেখানোর পর একটা হাতে নিয়ে আব্বাকে বললেন;'চাচা এটা নেন,দাম প্রতি গজ সত্তর টাকা মাত্র। ও (আমি) এখনো অনেক ছোট এত বেশি দামী কাপড় দেওয়ার দরকার নেই'।আব্বা বললেন,'তুমিকি জান? ও যে পবিত্র কুরআনের পনের খন্ড তথা অর্ধেকের হাফেজ। ওকে এর চেয়ে তিনগুণ দামী কাপড় দিতে হবে'।তিনি তাই দিয়েছিলেনও।কেন দেবেন না।আমি যে তাঁর চৌদ্দ বছরের অশ্রুশিক্ত প্রার্থনার ফসল আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বে কোনো একদিন পবিত্র কা'বা ঘরের গিলাফ ধরে তিনি নাকি দোয়া করেছিলেন; হে আল্লাহ! উচ্চ্বাসিত যৌবনটা কাটিয়েছি ভ্রষ্টতায়,বিচারদিবসে মুক্তির জন্য কিছু করেনি।যদি আর একটি সন্তান দাও তাকে আমি 'হাফিজুল কুরআন' করবো।
২০০৪ সালের ৮ই জুন তাকে ফিরিয়া আনা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল থেকে।তাঁর পাকস্থলীর ক্যান্সার! এখন আমি যে রুমে শুই আব্বাকেও সেই রুমে রাখা হয়েছে,পূর্ব-পশ্চিম ভাবে।আমি তখন কুরআনের ছাব্বিশ পারা মুখস্থ করেছি।বেলা ২টার দিকে হাফেজখানা থেকে আসলাম তাকে দেখার জন্য।আব্বা আমাকে ইশারা করে ডাকলে তাঁর শিয়রে গিয়ে বসি।তিনি আমাকে তাঁর মুখখানি আমার মুখে লাগিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কিছুক্ষণ।এই আলিঙ্গন সাধারণ আবেগ তাড়িত নয়;এটি হল কিরণ বিচ্ছুরিত মানিককে চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি ও বিদায়ী আত্মার হৃদয়ে পুঞ্জীভূত ভালবাসা ও স্নেহের সমাপনী ছোঁয়া। তারপর আমার কানে কানে বললেন; বাবা! আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারেনি।তোমাকে আল্লাহর নিকট আমানত রাখবো।দুনিয়ার কারো কাছে নয়। তাঁর রুগ্ন ভগ্ন কন্ঠস্বর আমার হৃদয় কুঠিরে আঘাত হানলো বজ্রপাতের মত। মনে হলো একটি ভারী পাথর খন্ড আমার বুকের ওপর ভর করছে।লোকচক্ষুর অন্তরালে গড়িয়ে পড়ল বেদনার নীল অশ্রু।
আহ! যে মানুষটির গর্জনে সারাবাড়ি ভরি নিস্তব্দতা নেমে আসতো আজ তাকেই অক্ষমতা গ্রাস করে ফেলছে! শুয়ে আছে নিরবে চির শান্ত সকালের শিশিরের মত।সেদিন আব্বাকে দেখতে আসা রুম ভর্তি মানুষের সামনে আমাকে তাঁর এহেন আদরে লজ্জিত হয়েছিলাম কিন্তু,আজ তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে তাড়িত করে।কাটে বিনিদ্র রজনী।নিরবে কাঁদে মন।চিত্তের নব পর্দায় আঘাত হানে তাঁর সেই উক্তি;মনে পড়ে তাঁর নিভৃতে ধ্যানমগ্ন হওয়া।
রাত অনেক গড়িয়েছে।সপ্তর্ষীমন্ডল ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে।চাঁদের সেই কিঞ্চিৎ আলো দখল করছে রুমের অর্ধেক যায়গা।দূর মসজীদ থেকে ভেসে আসছে সু-মধুর সুর-'আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম'।এখনো জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি।এমনি করে অনেক রাত কেটে যায়,চাঁদের সাথে ভাব জমিয়ে কিংবা আলো আধাঁরির সাথে স্বপ্ন সাজিয়ে।ভাবি,আমার যেসকল সহপাঠিরা পেছনের বেঞ্চে ছিল তারা আজ অঢেল বিত্তের মালিক।কিন্তু,আমরা যারা সামনের বেঞ্চে ছিলাম তারা এখনো সেই স্থানের একটু পেছনে,বই-খাতা কলম নিয়ে বকলম হয়ে।না পারি কাজ করতে না পারি কাজ দিতে।তবু ছেড়ে যাওয়া সাথীদের অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করি।অনবরত প্রতিক্ষার প্রহর গুনি হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের আরেকটি বার উচ্চ্বাসিত আলিঙ্গন ও মিলনের।
বিষয়: সাহিত্য
১০৬৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিহতের মা আদালতের দারস্থ হয়েছিল কিনা সে বিষয়গুলো কিন্তু উল্লেখ করেন নি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন